অযাচিত অতিথি


উত্তম দত্ত

পড়াশোনায় অমনোযোগী অনিকেত তখন ক্লাস এইট থেকে সবে নাইনে উঠেছে, সেইসময় এক রাতে হঠাৎ করে অনিকেতের মা শিবানী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা মৃত ঘোষণা করে। শিবানীর শেষকৃত্য সম্পন্ন হওয়ার তেরোদিন পর শ্রাদ্ধশান্তি মিটে যাবার পর অনিকেতের মামা অনিকেতকে তাদের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু এই কয়েকদিনেই অনিকেত কৈশোর থেকে প্রাপ্তবয়স্কে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। সে বুঝে গিয়েছিল, তার অবর্তমানে তার বাবা অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করে সেও মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে। তাই সে বাবাকে একা ফেলে রেখে মামার বাড়ি যাওয়া থেকে বিরত থাকে।

শুরু হয় বাপ-বেটার নতুন করে বাঁচার লড়াই। এই লড়াই লড়তে লড়তে বাপ-বেটা অতিক্রান্ত করে ফেলে দশ বছর।

এই দশ বছরে তাদের জীবনে ঘটে যায় অনেক কিছুই। তারমধ্যে অন্যতম হলো অনিকেতের বাবার শিক্ষকতার চাকুরি জীবন থেকে অবসরগ্রহণ এবং সেই গ্রামে তাদের নিজস্ব বাড়ি। এছাড়া নিজের পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চাকুরি পেয়ে সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে শহরে বসবাস।

অনিকেতের বাবা সমরেশবাবু গ্রামের নিজের বাড়িতেই একাই বসবাস করেন। বাড়ির সামনে বাগানের দেখভাল করা, নিজের খাবার রান্না করা এবং খবরের কাগজ ও বইপত্র পড়েই নিজের অবসর জীবন নিয়েই একপ্রকার দিনাতিপাত করছিলেন। রাতে একবার নিয়ম করে ছেলে-বৌমার সাথে ফোনে কথা বলতেন।

গত কয়েকদিন ধরে সমরেশবাবুর শারীরিক নানান সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার জন্য তিনি স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তারের পরামর্শ মতো শহরে যাওয়ার কথা ভাবতে বাধ্য হন। কিন্তু শহরের কোলাহল ও পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন কিনা এনিয়ে তিনি যথেষ্ট সন্দিহান হয়ে শহরে যাওয়ার পরিকল্পনা মুলতবি রাখেন। কিন্তু অনিকেতের জেদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে শহরে চলে যান।

ছেলের বাড়িতে প্রথম কয়েকদিন ঠিকঠাক চললেও, তিনি বুঝতে পারেন ছেলে ও বৌমার কাছে তিনি একজন অযাচিত অতিথি মাত্র সেখানে। এই নিয়ে ছেলে ও বৌমার মধ্যে একটা চাপা মতান্তর চলতে থাকে তুষের আগুনের মতো। যার লেলিহান শিখা দেখা যায় না ঠিকই, কিন্তু আগুনের তাপ বোঝা যায় তার আশপাশে থাকার দরুন। এরপর সেখানে থাকা মানে নিজের মানসম্মানকে সেই আগুনে পুড়তে দেওয়া। এইসব সাতপাঁচ ভাবার মাঝেই তিনি স্থির করেন, নিজের বলতে এই শরীরটাকে তিনি কার জন্য সুস্থ করবেন? এই মুহুর্তে তাঁর পিছুটান বলতেও কেউ নেই। আর এক মুহুর্তের জন্য এই বাড়ির অতিথি হিসেবে নিজেকে সঁপে না রেখে রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়েন বাস স্ট্যান্ডের দিকে। সেইসময় হঠাৎ করে আকাশের একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র সমরেশবাবুকে বলতে থাকে, “কার উপর অভিমান করছো তুমি? আমাদের বাবু এখন বড় হয়ে গেছে। সে এখন নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে। চলে এসো আমার কাছে। আমি তোমারই অপেক্ষায় আছি।”

কালবিলম্ব দেরি না করে সমরেশবাবু নিজের অসুস্থ শরীরটাকে ঠেলে দেন দুরন্ত গতিতে চলা এক লরির সামনে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here