গণতন্ত্রের উৎসব

উত্তম দত্ত

এবার অরুণ স্থির করে অনেক হয়েছে, এবার সংসারের সুদিন ফেরাতে যেতে হবে বাংলার বাইরে। কারণ, ওর বাল্যবন্ধু উদয় গত সাত বছর ধরে ব্যাঙ্গালোরে কাজ করে নিজের বাড়িঘর পাকা করে বিয়েথা করে বৌ-বাচ্চা নিয়ে সেখানেই বসবাস করছে। বছরে একবার করে বাড়িতে যখন আসে তখন ওর ঠাটবাট দেখে কে? গ্রামের অন্যান্যরা উদয়ের এই উন্নতিতে প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

পঞ্চায়েত ভোটের সময় গ্রামের পঞ্চায়েত মেম্বার উদয়দের বাড়িতে এসে উদয়ের বাবা-মাকে বলে যায়, “উদয় যেন ভোটের পনেরোদিন আগে যেন গ্রামে ফেরে। বাড়িতে ফেরার জন্য ও ভোটের আগ পর্যন্ত তাদের পার্টিতে কাজকর্ম করার জন্য পার্টির তহবিল থেকে তাকে পনেরো হাজার টাকা দেওয়া হবে।”
মেম্বারের কথা নাকচ করা উদয় বা তার পরিবারের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

ভোট পর্ব শেষ হওয়ার পর অরুণ উদয়ের সাথে পাড়ি দেয় ব্যাঙ্গালোরে এবং সেখানে সেও বহাল হয় সিকিউরিটি গার্ডের চাকুরিতে। থাকা-খাওয়া ফ্রি সেইসাথে মাসিক বেতন কুড়ি হাজার টাকা। এক বছর পর বাড়ি ফেরার সময় সে বাবা-মা এবং ছোট বোনের জন্য কাপড়চোপড় এবং সাংসারিক কিছু জিনিসপত্র নিয়ে এলে, বাড়ির সবাই খুবই খুশিতে ডগমগ করতে থাকে। এক মাস পর অরুণ আবার ফিরে যায় নিজের কর্মস্থলে। এইভাবেই অতিবাহিত হচ্ছিল অরুণের দিনগুলো।

অরুণ আজ বাংলা ছাড়া হয়েছে প্রায় পাঁচ বছর। এই সময়ে তার নিজের আয়ে দুটো পাকাপোক্ত ঘর তৈরি হয়েছে তাদের নিজেদের জমিতে কিন্তু ঘরগুলো ঠিক ভরা ভরা লাগে না অরুণের বাবা-মায়ের চোখে। তাই তারা স্থির করেন এবার ছেলে বাড়িতে ফিরলে তাকে বিয়ে দিয়ে বাড়ির এই শূণ্যস্থান পূরণ করবেন।

অগ্রহায়ণের চার তারিখ পাশের গ্রামের মেয়ে মেঘনার সাথে অরুণের বিয়ে হয় বাবা-মায়ের পছন্দ মতো। পৌষের শীতে নবদম্পতি যখন নিজেদের দুটি মন ও প্রাণ নিয়ে নিজেদের মধ্যে একাত্ম হওয়ায় মত্ত, ঠিক সেসময় কর্মক্ষেত্র থেকে ফোন আসে আগামী সপ্তাহের মধ্যেই অরুণকে কাজে যোগদান করতে হবে।

ব্যাঙ্গালোর ফেরার পনেরো দিন পর অরুণ জানতে পারে সে বাবা হতে চলেছে। আনন্দে আত্মহারা অরুণ দিন গুণতে থাকে নিজের সন্তানের জন্মের সময় বাড়ি ফেরা নিয়ে। এর ঠিক চারমাস পর, লোকসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণা হয়, গ্রামের ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন হোমড়াচোমরা এসে গ্রামের প্রতিটি পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়িতে এসে ফরমান জারি করে, “গ্রামের যেসকল পুরুষমানুষ কাজের সুবাদে রাজ্যের বাইরে থাকে তাদের সকলকে গণতন্ত্রের এই মহান কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করার জন্য ভোটের দশদিন আগে গ্রামে ফিরে আসতে হবে এবং ভোটের কাজ করার জন্য তাদের দলের সদস্য হিসেবে কাজ করতে হবে।”
কথাগুলো শুনে অরুণের স্ত্রী মেঘনার আর আনন্দ ধরে না। মনে মনে সে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছিলো দেশের এই গণতন্ত্রের উৎসব পালনের জন্য। সেইসাথে সেই ধন্যবাদ জানাচ্ছিল বাড়িতে উপস্থিত সেই নেতাদের। ভোটের বারোদিন আগেই অরুণ ও গ্রামের অন্যান্য মানুষজন নিজেদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়।

প্রতিদিনের মতো আজও অরুণ প্রাতঃরাশ শেষ করে বেরিয়ে যায় ভোটের প্রচারে পার্টির অন্যান্য নেতাদের সাথে। গ্রামের হাটের মাঠে সেদিন ছিলো বিরোধী পক্ষের রাজনৈতিক মিটিং। সেই মিটিং চলাকালীনই সেখানে গন্ডগোল বাঁধে। সেই গন্ডগোল চরম আকার ধারণ করলে পুলিশ বাধ্য হয় গুলি চালাতে। পুলিশের গুলিতে বিদ্ধ হয় সাতজন। তাদের মধ্যে তিনজন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। সেই হতভাগ্য তিনজনের মধ্যে অরুণও ছিল সেই তালিকায়।

পরদিন ময়নাতদন্তের পর অরুণের মৃতদেহ বাড়িতে আনার পর তার বাবা-মা ও বোন কান্নায় ভেঙে পড়ে। অন্তঃস্বত্তা মেঘনা নিজের পেটের ওপর হাত বুলিয়ে স্বামীর নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে গণতন্ত্রের মহান উৎসবের উপহারে স্তম্ভিত ও বাকরুদ্ধ হয়ে স্বগতোক্তি করে বলতে থাকে… ………।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here